লেখকঃ মোসাব্বিরা রহমান মৌসুমী
আপনার কি মাঝে মাঝেই খুব অসহ্য আর অসহায় মনে হয় নিজেকে? কিংবা একদমই ভাল লাগে না বন্ধুদের সাথে আড্ডায় যেতে বা কথা বলতে! অথবা খুব পছন্দের কাজ বা বিষয়টির প্রতিও হারিয়ে ফেলছেন আগ্রহ! গতি হারিয়ে যাচ্ছে সাধারণ আর স্বাভাবিক কাজকর্মে? বেঁচে থাকার স্বাদ আর ইচ্ছাকে বুড়ী আঙুল দেখিয়ে কখনও কখনও কি প্রবল আকাঙক্ষা জাগে অনেক দূরে অজানার পথে পাড়ি জমাতে ?
জীবনের চলার পথে হরহামেশাই এসব অনুভূতি কম বেশি আমাদের দেখা দেয়। মন খারাপ বা ভাল লাগছে না বলেই খুব তুচ্ছভাবেই আমরা উড়িয়ে দেই ব্যাপারগুলো। অথচ হয়তো আপনি দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ কিংবা বছরের পর বছর ভুগে যাচ্ছেন এই সমস্যা নিয়ে, যা Depression বা বিষণ্ণতা নামক একটি মারাত্মক মানসিক অবসাদ!
বিশ্বব্যাপি ২৬৪ মিলিয়ন এরও বেশি মানুষ এই মানসিক অবসাদ রোগটির শিকার। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর প্রায় ৮ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে , গুরুত্ব না দেয়া এই Depression সংক্রান্ত জটিলতার জট খুলতে না পেরে। আবার গবেষণা বলছে, এদের ৭৬%- ৮৫% রোগীর বসবাস নিম্ন আর মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। তবে এমন ভাবারও আবার কোনও কারণ নেই যে, উন্নত দেশের মানুষজন বিলাসবহুল জীবনযাপন করার জন্য হয়তো কোনো রকম হতাশার সম্মুখীন হচ্ছেন না। জরীপ বলছে সবচেয়ে বেশি মানসিক বিষণ্নতায় ভুগে থাকেন আমেরিকাবাসী। পিছিয়ে নেই সেই দলে চায়না, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য কিংবা ফ্রান্স। আমেরিকাতে প্রতি ৫ জন প্রাপ্ত বয়স্কের মধ্যে ১ জনের অন্তত দেখা দেয় Depression বা বিষণ্ণতার মারাত্মক কোনো না কোনো লক্ষণ। ফলশ্রুতিতে এই চিকিৎসা খাতে বছরে গুনতে হয় ২১০ বিলিয়ন ডলার! অতএব, বিষয়টি যে ভয়াবহ এবং গুরুত্বপূর্ণ তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
খুব হাশিখুশী থাকা, সারাক্ষণ সবাইকে আনন্দে মাতিয়ে রাখা আপনার বন্ধু বা আত্মীয়, যাকে দেখে বোঝার উপায়ই নেই সে হয়তো Smiling Depression বা Atypical Depression নিয়ে দিনাতিপাত করছেন। এই ধরণের মানুষদের ক্ষেত্রে কিছু লক্ষণ দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে, যেমন- ঘুম বেড়ে যাওয়া, খাওয়া বেড়ে যাওয়া, ঘুম থেকে উঠার পর হাত পা ভারী হয়ে যাওয়া, কোনো ভাবেই কারো থেকে কোনো রূঢ় মন্তব্য বা প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে না পারা, সকালের দিকে মন খারাপ না থাকলেও বিকালের দিকে মনখারাপ থাকা এবং মাত্রাতিরিক্ত আত্মহত্যার প্রবণতা। এদের টানা মন খারাপ থাকে না তবে যখন এরা বিষন্নতায় ডুবে যায় তখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেশ বিপাকে পরে। তাই সপ্রতিভ থাকা মানেই কিন্তু সুখে থাকা না।
এর উল্টো আবার Dysthymia যাকে Persistent Depressive Disorder বা Chronic Low Grade Depression বলা হয়। যখন কোনো ব্যক্তির একটানা দীর্ঘ সময়ব্যাপি মন খারাপ থাকে( প্রায় ২ বছরের বেশি) এবং যার প্রভাবে তার মধ্যে হীনমন্যতা, মনোযোগের অভাব, অনিদ্রা, অতিরিক্তি খাদ্যাভ্যাস এবং আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
অনেকে আবার Seasonal বা Situational depression এও ভুগে থাকেন। কোনো অতীত ট্রমা বা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির জন্য এ ধরনের ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে। আবার মারাত্মক ডিপ্রেশনের বশবর্তী হয়ে অনেকেই অনুভব করেন Hallucination and Delusion ( দৃষ্টিভ্রম বা মতিবিভ্রম) , চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় Depressive Psychosis বা Psychotic Depression.
অতএব, আপনি যদি আপনার কষ্ট, দুঃখ কিংবা হতাশাকে লুকিয়ে রাখেন তার ফল নিজের জন্য কখোনই মঙ্গলজনক হবেনা। প্রাথমিক পর্যায়ে পরামর্শ নেয়া যেতে পারে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের আর সঠিকভাবে চিকিৎসা আপনাকে দিতে পারে সুন্দর প্রানোচ্ছোল জীবন। মনোনিবেশ করতে পারেন ধর্মীয় অনুশাসনের প্ৰতি এবং নিজেকে সংযুক্ত করতে পারেন আর্ত মানবতার সেবায়। কথা বলুন প্ৰিয়জনদের সাথে , পরিবারকে সময় দিন আর নিজেকে মুল্যায়ন করুন। আশেপাশে তাকালে দেখবেন, আপনার মত আরও অনেকেই জীবনে কঠিন সময় পার করেছে কিন্তু থেমে যায়নি। ২৮ বার অলিম্পিক বিজয়ী মাইকেল ফিলিপস, আমেরিকান সঙ্গীত শিল্পী ব্রুস স্প্রিংস্টিন, বিখ্যাত অভিনেত্রী গোয়েনেথ প্যালট্রো, হ্যারি পটার খ্যাত ম্যাজিকাল লেখিকা জে. কে. রাউলিং, চন্দ্র বিজয়ী বাজ্ অলড্রিন, হলিউড খ্যাত ডোয়েইন জনসন বা দ্যা রক , এমনকি কিংবদন্তি ব্যাক্তিত আব্রাহাম লিঙ্কনও জীবনের কোনও না কোনও পর্যায়ে পরেছেন নিদারুণ মানসিক চাপে।
যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে Depression এর ভয়াল থাবা আরো ব্যাপকভাবে আমাদের মধ্যে হানা দিয়েছে। বৈশ্বিক মহামারী, প্রতিনিয়ত মৃত্যু মিছিল,গৃহ অবরুদ্ধতা আর সেই সাথে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ; প্রতি মুহূর্তে আমাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে হতাশার এক গহীন গহ্বরে। দেখা যাচ্ছে মার্চ থেকে এপ্রিল এর মাঝেই মিলেছে ১০০০ গুন বেশি ডিপ্রেশনে ভুক্তভোগীর সংখ্যা। তাই জানতে চেষ্টা করুন আপনার পাশের, কাছের অথবা পরিচিত মানুষটি ভালো আছে কি?
লেখকঃ মোসাব্বিরা রহমান মৌসুমী