লেখকঃ জহিরুল হক জাবেদ
“ভাইয়া আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল। জানিনা আমার মেসেজ আপনি আদৌ দেখবেন কিনা! যদি কখনো দেখে থাকেন তাহলে জেনে রাখবেন কেউ একজন আপনাকে কিছু কথা বলতে চেয়েছিল। আচ্ছা খুব দীর্ঘায়িত করব না।
আমার মানুষ খুন করতে ইচ্ছে করে। হুট করে যে এমন ইচ্ছে করে তা নয়। আমার দিনের বেশিরভাগ সময় ই খুন করতে ইচ্ছে করে। মন চায় কাউকে খুন করি। তাজা তাজা রক্ত ঝরবে। আমি মাথার খুলির কাছে বসে রক্ত দেখব। মাথা থেকে রক্ত বের হয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচ তলায় চলে যাবে। কিছু সময় পর রক্ত জমাট বাঁধবে। বাসায় যেই ঢুকতে চাইবে রক্ত দেখে ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাবে। আমি সেই মুহুর্ত দেখব আর হুহু করে হাসবো। ভাইয়া রক্ত দিয়ে গোসল করেছেন কখনো? আমি একবার হলেও করতে চাই। সেদিনের একটা ঘটনা বলি। আমার গার্লফ্রেন্ড এসেছে আমাদের বাসায়। আমার জন্মদিন ছিল। আমাদের বিয়ে ঠিক। তাই ও মাঝে মাঝেই আমাদের বাসায় আসে। বাবা মায়ের অনুমতি আছে। টেবিলে কেক রাখা আছে। পাশে একটা ছুরি। সোফায় বাবা মা, ছোট বোন বসা। কেকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রেমিকা। আমার খুব ইচ্ছে করছিল ছুরি হাতে নিয়ে প্রেমিকার পেটে ঢুকিয়ে দেই। তারপর ওর পেট থেকে রক্ত বের হবে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব। আমি প্রায় ১০ মিনিট এই দৃশ্য কল্পনা করছিলাম। হুশ ফিরে আম্মুর ডাকাডাকিতে। সবাই অপেক্ষা করছে আমি যাতে তাড়াতাড়ি কেক কাটি। আর আমি কিসব ভাবছি!! নিজের প্রতি ঘৃণা আসল। এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে। ওয়াশরুমে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে চোখ মুছে বের হলাম। ভাইয়া আমার এমন মনে হয় কেন? আমি কি মানসিক সমস্যায় ভুগছি? মুক্তির উপায় আছে? শুনেছি সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের অডিটরি হ্যালুসিনেশন হয়। ছাদ থেকে লাফ দিতে কিংবা কাউকে খুন করতে গায়েবি আদেশ শুনে। আমার এমন মনে হয় না।
আরেকটা কথা। আমি খুব গোছানো থাকতে পছন্দ করি। অপরিষ্কার মানুষজন আমার পছন্দ না। ওদের দেখলেই খুন করতে মন চায়। সেদিন ক্লাসে এক ছেলের পাশে বসেছিলাম। ওর ব্যাগ আমার ব্যাগের সাথে লাগে। আমার অনেক অস্বস্তি লাগছিল। আমি সাথে সাথে ব্যাগ নিয়ে ওয়াশরুমে গেলাম। ওর ব্যাগ যে জায়গায় লেগেছিল সে জায়গা পানি দিয়ে পরিষ্কার করলাম। ক্লাসে গেলাম। কিন্তু ক্লাস করতে বিরক্ত লাগছিল। মনে মনে ছেলেটাকে অনেক গালি দিচ্ছিলাম। ক্লাস শেষ না করেই বাসায় চলে আসি। পুরো ব্যাগ ভালো করে ধুয়ে নিজের রুমে ঢুকি। কিন্তু তবুও মন মানছিল না। যেই ড্রেস পড়ে ছিলাম সেটা ভালভাবে ধোয়ার পরে মনে শান্তি আসলো। আমি এক জামা না ধুয়ে দ্বিতীয়বার পড়ি না। ভাইয়া এসব কি কোনো রোগের লক্ষণ? আমাকে প্লিজ জানাবেন। আমার খুব ভয় হয় কবে কাকে ছুরিকাহত করে ফেলি। তাই ইচ্ছে করে নিজেই আত্নহত্যা করি। আমার জন্য কেউ মারা যাবে তা কেন চাইবো? তার চাইতে নিজেই চলে যাই। কি বলুন? আমার কথা শেষ। ভালো থাকবেন ভাই।”
আমি এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পড়লাম। ওর মেসেজের রিপ্লাই দিতে পারিনি। হয়তো কিছুদিন অপেক্ষা করেছিল আমার রিপ্লাইয়ের। মেসেজ রিকুয়েষ্ট সিন করা হয়না বলে উত্তর দেওয়া হয় নি। তাই রাগ করে আমাকে ব্লক করে রেখেছে। এখন আমার মনে ভয় ঢুকে গেছে। ছেলেটা আত্নহত্যা করে ফেলেনি তো? কিংবা কাউকে খুন করে নি তো? খুব সম্ভবত ও অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারে (শুচিবাই) ভুগছে। ওর সাথে বিস্তারিত আলাপ করতে পারলে নিশ্চিত হওয়া যেত। এ রোগীরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। পারসোনাল হাইজিন মেইনটেইন করা খুব ভালো কাজ। কিন্তু যখন এটা তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনযাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন এটাকে আর ভালো দিক বলার সুযোগ থাকে না। দেখা গেছে এরা একবারের জায়গায় হাত ধুয় কয়েকবার। খেতে বসে প্লেট পরিষ্কার করে, মনে সঙ্কোচ থাকে, আবার পরিষ্কার করে, আবার এবং আবার…..! বাসা থেকে বের হয়ে মনে হয় দরজায় তালা দেয় নি, বাথরুমের টেপ ছাড়া, গ্যাসের চুলা বন্ধ করে নি। সবকাজ ফেলে আবার বাসায় আসে। মনের সঙ্কোচ দূর হয়। তার হাতে,প্লেটে মনে হয় জীবাণু আছে এমন চিন্তা করে বারবার। একে বলে অবসেশন। আর এই চিন্তা থেকে বারবার হাত ধুতে যায়,প্লেট ধুতে যায়। একে বলে কম্পালসান।
ওর সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে কাছের এক বন্ধুর সাথে ঘটনা শেয়ার করি। ও হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে “আত্নহত্যা করা এত সহজ নয়। সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। যাকে ভালোবাসে তার সাথে বিয়েও ঠিক অথচ তাকেই মারতে চায়। কুত্তার পেটে ঘি হজম হয়না। এইসব ন্যাকামি। এদের মরে যাওয়াই উচিত। ” কারো মানসিক সমস্যা নিয়ে তিরস্কার না করতে অনুরোধ করলাম বন্ধুকে। ও আমাকে গালি দিয়ে চলে গেলো।
আমি রিকুয়েষ্ট মেসেজগুলো চ্যাক করতে লাগলাম। যদি তার প্রেমিকা কিছু হলেও জেনে থাকে সে নিশ্চয়ই আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর প্রিমা নামের এক মেয়ের মেসেজ পেলাম। ছেলেটার নাম ওবায়েদ। সে এই মুহুর্তে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে আছে। ৪ দিন আগে নিজের পেটে নিজেই ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমি প্রিমাকে বললাম দেখা করতে আসবো।
দেখা করতে যাওয়ার আগে ফোন দিলাম সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ হারুন অর রশিদ স্যারকে। উনার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। নিজের সন্তানের মতই পছন্দ করেন। উনি চান আমিও একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হই। উনার বিশ্বাস আমার সাথে কথা বললে অনেকের মনের অবস্থার উন্নতি হবে।আমি খুব তাড়াতাড়ি মানুষের আপন হতে পারি। তাই উনি মাঝে মাঝেই আমাকে উনার চেম্বারে ডাকেন। রোগী দেখান।। রোগীর সাথে কথা বলতে দেন। উনার আমার প্রতি এমন বিশ্বাস কেন সেটা আমি জানিনা। তবে এটা জানি সাইকিয়াট্রিষ্টরা চোখ, মুখের অঙ্গভঙ্গি, হাঁটাচলার গতিবিধি দেখে মানুষের মনের অবস্থা বুঝতে পারেন। কিন্তু আমার সাইকিয়াট্রিস্ট হবার তেমন ইচ্ছে নেই। স্যার আমাকে আদেশ করলেন আজই যেন ওবায়েদের সাথে দেখা করি। আর ও একটু সুস্থ্য হলে যেন স্যারের চেম্বারে নিয়ে যাই।
আমি দুপুর একটায় হাসপাতালে গেলাম। রিসিপশন ডেস্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ওবায়েদ ২০৭ নাম্বার কেবিনে আছে। ২০৭ নাম্বার কেবিন আমার খুব প্রিয়। হাসপাতাল কারো প্রিয় হয়? মনে হয় না। আমাদের হাসপাতালের ২০৭ নাম্বার কেবিন স্টুডেন্টদের জন্য বরাদ্দ। সিট ভাড়া লাগে না। খাওয়া ফ্রি। আমি প্রতি মাসে একবার হলেও অসুস্থ্য থাকি। ভর্তি হতে হয় ২০৭ নাম্বার কেবিনে। এই হিসেবে ২০৭ এর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা! আর তাছাড়া হাসপাতালে ভর্তি থাকলে বাবা মা, বন্ধু বান্ধবদের কেয়ার পাওয়া যায়!! নিম্ফোম্যানিয়ায় আক্রান্ত একজন মহিলার কথা বলেছিলাম। ছোট থেকেই বাবা মায়ের আদর যত্ন পেত না। বাবা মা ব্যস্ত থাকতেন তাই হয়ত মেয়েকে সময় দিতে পারতো না। মেয়ে চাইতো তার বড় অসুখ হোক, ক্যান্সার হয়ে যাক। সারাবছর অসুস্থ্য থাকবে। হাসপাতালে ভর্তি থাকবে। বাবা মা অনেক সময় দিবে। আদর যত্ন করবে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করুন ব্যাপারটা খুব এলার্মিং!! পিচ্চি একটা বাচ্চার মাথায় এসব চিন্তা! বেশিরভাগ মানসিক সমস্যার পিছনে পরিবারের ভূমিকা থাকে। অথচ আমরা আমাদের ছোট বাচ্চাদের হাতে মোবাইল তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকি। কাজের মেয়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকি। তার চাওয়া পাওয়া পূরণ করার সময় আমাদের নেই!
:ভেতরে আসতে পারি?( আমি)
:জ্বি আসুন। ( খুব সম্ভবত ওবায়েদের আম্মু)। চেয়ারে বসুন।
:জ্বি ধন্যবাদ। আমি কি উনার সাথে একটু একা কথা বলতে পারি?
: প্রিমা চলো আমরা একটু বাহিরে যাই।
উনারা চলে গেলেন। ওবায়েদ আমার হাত শক্ত করে ধরলো। বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। আমি ওর সব কথা শুনলাম। ও ওসিডি তেই ভুগছে। এই রোগের প্রায় সব লক্ষণ ই ওর মাঝে আছে। আমি সাইকিয়াট্রিস্ট হারুন অর রশিদ স্যারের সাথে ওর আলাপ করিয়ে দিলাম। ও হাসপাতাল থেকে রিলিজ হলে স্যারের সাথে দেখা করবে। ওর আম্মুর সাথে পুরো ব্যাপারটা শেয়ার করলাম। আন্টি আমার উপর অনেক অভিমান করেছেন। উনার বিশ্বাস আমি আগেই যদি ওর মেসেজ দেখতাম তাহলে এমন কিছু হতো না। নিজের কাছেও খারাপ লাগছিল। বুঝালাম যে আমার পরীক্ষা চলছে।আপাতত ওবায়েদের কাছ থেকে বিদায় নেই। ভালো থাকুক সে। তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরুক।
লেখকঃ জহিরুল হক জাবেদ